শক্তির সংরক্ষণ সুত্র । যান্ত্রিক শক্তির নিত্যতা
শক্তির সংরক্ষণ সুত্র।যান্ত্রিক শক্তির নিত্যতা
আজকের আলোচ্য বিষয় হচ্ছে শক্তির সংরক্ষণ সুত্র।
শক্তির সংরক্ষণ সুত্র এর শক্তির সৃষ্টি বা ধ্বংস কোনটি নাই। শক্তির শুধুমাত্র রূপান্তর সম্ভব। আর এই রুপান্তরের আগে ও পরে মোট শক্তির পরিমাণ বা যোগফল ধ্রুব বা একই থাকে। অর্থাৎ রুপান্তরের পরে শক্তির যোগফল আর রুপান্তরের আগে যে শক্তি তার সমান।
উদাহরণ হিসেবে শক্তির সংরক্ষণ সুত্রের বলা যায়, বাষ্পীয় ইঞ্জিনে শক্তির রূপান্তর ঘটে।এর মধ্যে কয়লা পুড়িয়ে যে তাপ শক্তি উৎপন্ন করা হয়, তা দিয়ে পানিকে বাষ্পীভূত করে ইঞ্জিন চালানো হয়। তাহলে দেখ কয়লা রাসায়নিক শক্তিকে প্রথমে তাপ শক্তিতে এবং পরে যান্ত্রিক শক্তিতে রূপান্তরিত করে। সুন্দর ভাবে বলতে গেলে মনে করো আমরা নির্দিষ্ট পরিমাণ কয়লা পুড়িয়ে ঠিক নির্দিষ্ট পরিমাণ তাপ শক্তি পাবো। ওই শক্তি দিয়ে পানিকে বাষ্পীভূত করে বাষ্পকে কাজে লাগিয়ে একটা টারবাইন ঘুরানো হবে ওই টারবাইন এর জেনারেটর দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হবে। তাহলে দেখ যতটুকু কয়লা পুড়িয়েছিলাম ঠিক ততটুকু তাপ শক্তি পাইছি,ওই একই পরিমাণ পানিকে বাষ্পীভূত করেছি আবার যতটুকু বাষ্প পেয়েছি তা দিয়ে ঠিক ততটুকু বিদ্যুৎ শক্তি পাইছি। এখন দেখো শক্তির কি আসলেই বিনাশ বা নষ্ট হওয়ার চান্স আছে মোটেও নাই।তাই বলা যায় শক্তির সৃষ্টি বা ধ্বংস কোনটি নাই এটা শুধুমাত্র রূপান্তর করা হয়।
এখন শক্তির সংরক্ষণ সুত্রের একটু গানিতিক ব্যাখ্যা টুকু দেখি,
ধরা যাক,কোন একটা সিস্টেম বা ব্যবস্থার মোট শক্তি হচ্ছে E। এই শক্তি কোন একটা কারনে অন্য কোন শক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে গেল। তাহলে এই রুপান্তরিত শক্তির রুপভেদ গুলো হলো -
১. বিভবশক্তি(U)
২. গতিশক্তি(K)
৩. তাপ শক্তি(Q)
৪. অনান্য শক্তি হতে পারে।
তাহলে শক্তির সংরক্ষণ সুত্র বলতে বুঝায়,
E=U+K+Q+অনান্য শক্তি
আইনস্টাইনের আপেক্ষিক সুত্র আবিষ্কারের পর শক্তির সংরক্ষণ সুত্রের সংশোধিত রুপ হচ্ছে -
মহাবিশ্বের ভর ও শক্তির যোগফল ধ্রুব। মহাবিশ্বের মোট ভর বা মোট শক্তি আলাদাভাবে ধ্রুবক নয়। ভর থেকে শক্তি এবং শক্তি থেকে ভর সৃষ্টি হয় করা যায়।
এটি আইনস্টাইনের আপেক্ষিক সুত্রের শক্তির সংরক্ষণ সুত্রের সংশোধিত রুপ।
চলুন তাহলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে শক্তির সংরক্ষণ সুত্রের প্রমান দেখে নেই:
ক. পড়ন্ত বস্তুর ক্ষেত্রে শক্তির সংরক্ষণ সুত্র
m ভরের একটি বস্তুকনা ভূপৃষ্ঠ হতে h উচ্চতায় কোন বিন্দু B তে অবস্থান করছে। B বিন্দুতে অবস্থান করলে গতিশক্তি থাকবে না বিভবশক্তি থাকবে।
বিভব শক্তি = mgh
গতিশক্তি = 0
মোট শক্তি,E =বিভব শক্তি+গতিশক্তি
= mgh + 0
= mgh .........................(1)
এখন বস্তুটাকে B বিন্দুতে ছেড়ে দেওয়া হল এবং এটি অবাধে পড়তে শুরু করল এবং কিছু সময় পর নির্দিষ্ট দুরত্ব অতিক্রম করে C বিন্দুতে পৌঁছায় এবং v প্রাপ্ত হয়।
v²= 2g(h-x)
আদিবেগ, u=0
C বিন্দুতে গতিশক্তি, K= 1/2 mv²
= 1/2 m× 2g(h-x)
= mg(h-x) ......................(2)
C বিন্দুতে বিভবশক্তি, U = mgx .......................(3)
এখন C বিন্দুতে মোট শক্তি, E = K + U
= mg(h-x) + mgx
= mgh ................(4)
B বিন্দুতে মোট শক্তি= C বিন্দুতে মোট শক্তি
পড়ন্ত বস্তুর ক্ষেত্রে শক্তির সংরক্ষণ সুত্র প্রমানিত হল।
খ. সরলদোলকের ক্ষেত্রে শক্তির সংরক্ষণ সুত্র
বিস্তার থাকলে:
সরলদোলকের B বিন্দুতে ববের বেগ v=0 হওয়া এর সমস্ত শক্তি হবে বিভবশক্তি। আর দোলকের উপর ক্রিয়ারত বল হবে, F = -kx
B বিন্দুতে বিভবশক্তি, U = 1/2 kA²
K = mω² হলে
U =1/2 mω²k²
কিন্তু B বিন্দুতে গতিশক্তি K = 0
B বিন্দুতে মোট শক্তি ,E = 1/2 mω²k² ........(5)
এখন ধরা যাক, ববটি B বিন্দু থেকে C বিন্দুতে পৌঁছাল। তাহলে সাম্যবস্থান থেকে C বিন্দুর দুরত্ব x এবং C বিন্দুতে v বেগ হলে C বিন্দুর গতিশক্তি
K = 1/2 mv²
কিন্তু সরলদোলকের বেগ, v =ω√(A²-X²)
অতএব K = 1/2 mω²(A²-X²)
বিন্দুতে বিভবশক্তি, U = 1/2 kx² = mω²x²
C বিন্দুতে মোট শক্তি E = গতিশক্তি + বিভবশক্তি
= 1/2 mω²A² ..........(6)
অতএব B বিন্দুতে মোট শক্তি = C বিন্দুতে মোট শক্তি।
সরলদোলকের ক্ষেত্রে শক্তির সংরক্ষণ সুত্র প্রমানিত হল।
সমাধান সুত্র:
(কোন ও সুতার দৈর্ঘ্য উল্লেখ থাকলে শক্তির সংরক্ষণ সুত্র)
সরলদোলকের দোলনের সময় প্রতিনিয়ত গতিশক্তি বিভবশক্তির পরিবর্তন ঘটলেও যোগফল সর্বদা সমান থাকে। এখন মনে করো দোলকের ভর m এবং ওই স্থানে অভিকর্ষ g এর ফলে দোলকের উপর অভিলম্বিক বল খারা নিচের দিকে কাজ করে
C বিন্দুতে সরল দোলকের গতিশক্তি শূন্য।কারন ওই বিন্দুতে দোলকটির বেগ শুন্য এবং খাড়া AN দুরত্ব (উচ্চতা) অতিক্রম করে
C বিন্দুতে তাহলে বিভবশক্তি U = mgh [h=AN]
অতএব মোটশক্তি, E = mgh ....................(1)
এখন দোলকটি c বিন্দু থেকে যখন B বিন্দুতে আসে। তখন এর বেগ v হলে
গতিশক্তি K = 1/2 mv²
= 1/2 m× 2gNM ( v²= u² +2gNM ; h= NM এবং u=0)
= mgNM
B বিন্দুতে বিভবশক্তি, U = mgAM ( h= AM)
বলে রাখা ভালো গতিশক্তির উচ্চতা উপর থেকে নিচে নেওয়া হয়,বিভবশক্তির উচ্চতা বব থেকে শুরু করতে হয় ।
তাহলে B বিন্দুতে মোটশক্তি,E = mgAM + mgNM ............(2)
সুতরাং দোলকের B বিন্দুতে মোট শক্তি এবং A বিন্দুতে মোট শক্তি সমান হলে শক্তির সংরক্ষণ সুত্র মেনে চলবে।
গ. আনত মসৃণ তল বরাবর গতিশীল বস্তুর ক্ষেত্রে শক্তির সংরক্ষণ সূত্র
ধরা যাক, একটি হেলানো তলের সাথে θ কোণে আনতে থাকলে এবং বস্তুর ভর m হলে বস্তুর ওজন হবে w=mg । বস্তুটি ভূমি হতে BC = h উচ্চতায় অবস্থিত। অতএব B বিন্দুতে তার সব শক্তি বিভবশক্তি তার কোন গতিশক্তি নেই।
B বিন্দুতে বস্তুর বিভব শক্তি = mgh
B বিন্দুতে বস্তুর গতিশক্তি = 0
B মোট শক্তি = mgh
এখন বস্তুটিকে ছেড়ে দেওয়া হল এবং এটি নততল বরাবর পড়তে শুরু করল এবং D বিন্দুতে আসলো। D বিন্দুতে বস্তুর গতিশক্তি বিভবশক্তি উভয় থাকবে।
নততল বরাবর বস্তুর উপর ক্রিয়াশীল বল= mgsinθ
নততল বরাবর বস্তুর ত্বরণ= gsinθ
∴ v²=0+2gsinθ. x= 2gxsinθ
D বিন্দুতে গতিশক্তি= 1/2mv² =1/2m.2gxsinθ=mgxsinθ
D বিন্দুতে বিভবশক্তি= mgx
অতএব D বিন্দুতে মোট শক্তি= mgxsinθ+ mgx ....(1)
সুতরাং বলা যায়, B বিন্দুতে মোট শক্তি এবং D বিন্দুতে মোট শক্তি সমান হলে শক্তির সংরক্ষণ সুত্র মেনে চলবে।
ঘ. প্রাসের ক্ষেত্রে শক্তির সংরক্ষণ সূত্র
মনে করি, m ভরের একটি বস্তুকে আনুভূমিক রেখার সাথে θ কোনে u আদিবেগে শূন্যে নিক্ষেপ করা হলে এক্ষেত্রে বস্তুর গতি অভিকর্ষজ ত্বরণ g দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে এবং বিভবশক্তি শূন্য হবে ।
A বিন্দুতে গতিশক্তি= 1/2 mu²
A বিন্দুতে মোট শক্তি= 1/2 mu² .........(1)
A বিন্দু হতে বস্তুকে নিক্ষেপের পর
আনুভূমি উপাংশ= ucosθₒ
উলম্ব উপাংশ= usinθₒ
এখন t সময় পরে বস্তুর অবস্থান সর্বোচ্চ h উচ্চতায়।
h উচ্চতায় বেগ= v
আনুভূমি উপাংশ= vcosθ
উলম্ব উপাংশ= vsinθ
এখন আনুভূমিকের দিকে কোন ত্বরন নেই বলে।
vcosθ=ucosθₒ
যদি অনুভূমিক রেখা হতে B বিন্দুর উচ্চতা h হয়, তাহলে v²=u²+2as সমীকরণ থেকে লিখা যায়।
v²= v²sin²θ
u² = u²sin²θ
as= gh
সমীকরণ দাড়ায়,
v²sin²θ = u²sin²θ-2gh
B বিন্দুতে গতিশক্তি
= 1/2 mv²cos²θ=1/2mu²cos²θₒ
B বিন্দুতে সর্বোচ্চ উচ্চতা বের করতে হলে h =u²sin²θₒ/2g
B বিন্দুতে বিভবশক্তি= mgh=1/2u²sin²θₒ
∴ B বিন্দুতে মোট শক্তি= 1/2mu²sin²θₒ+1/2mu²cos²θₒ
= 1/2mu²(sin²θₒ+cos²θₒ)
= 1/2 mu² ...................(2)
সমীকরণ (1) এবং (2) এর মোট শক্তি সমান হলে শক্তির সংরক্ষণ সূত্র মেনে চলবে।
ঙ. একটি হাইড্রোজেন পূর্ণ বলুন উপরে উঠতে থাকলে এক্ষেত্রে শক্তির সংরক্ষণ সূত্র
পৃথিবীর পৃষ্ঠা হতে একটি নির্দেশতল হিসাবে বিবেচনা করলে, হাইড্রোজেন গ্যাস ভর্তি বেলুনটি ভূপৃষ্ঠে স্থির অবস্থায় থাকায় তার বিবশক্তি= 0 এবং গতিশক্তি= 0 অর্থাৎ মোট যান্ত্রিক শক্তি= 0
এবার বেলুন টিকে উপড়ে ছেড়ে দেওয়া হলে গ্যাস ভর্তি বেলুনের ওজন যা হবে উর্ধ্বঘাত তার থেকে বেশি হওয়ায় বেলুনটি উপরে উঠতে থাকবে।
ধরা যাক বেলুনটির ভর=m এবং তার ওপর উর্ধ্বমুখী লব্ধি বল= F
সুতরাং বেলুনের ত্বরণ = F/m
ভূপৃষ্ঠ হতে h উচ্চতায় বেলুনটির বেগ v হলে, v²=u²+2as সুত্রানুসারে
v²=2.F/m.h
h উচ্চতায় গতিশক্তি= 1/2mv²
= 1/2m.2.F/m.h
=Fh
আমরা জানি একটি ঢিল যখন অভিকর্ষ বলের প্রভাবে আপনার থেকে নিচের দিকে পড়ে তখন কিন্তু কাজ ঋণাত্মক হয়। অনুরূপভাবে বেলুনটি যখন গড় উর্ধ্বমুখী লব্ধি বল এর প্রভাবে আপনা আপনি উপরে ওঠে, তখনও কৃত কাজ ঋণাত্মক।
সুতরাং h উচ্চতায় উঠালে,
কৃত কাজ = বেলুনের বিভবশক্তির পরিবর্তন=-Fh
যেহেতু বেলুনটির প্রাথমিক বিভবশক্তি শূন্য তাই h উচ্চতায় বিভবশক্তি = - Fh
hউচ্চতায় বেলুনটির মোট শক্তি=গতিশক্তি+ বিভবশক্তি
= -Fh+Fh
=0
অতএব একটি গ্যাসপূর্ণ বেলুন উপরে উঠতে থাকলেও মোট যান্ত্রিক শক্তি সংরক্ষিত হয় । এখানে লক্ষ্যণীয় যে উপরে উঠলে গতিশক্তি বাড়ে। কিন্তু বিভব শক্তি সমপরিমাণ কমে। সুতরাং উচ্চতা বাড়লে বেলুনের বিভব শক্তি বাড়ে এ কথা ঠিক নয় বিভবশক্তি প্রকৃতপক্ষে কমে।
আরো পড়ুন: শক্তি কি? শক্তির প্রকারভেদ।
আরো পড়ুন: কাজ কাকে বলে? কাজের প্রকারভেদ।